কক্সবাজার বেতার আরডির বিরুদ্ধে কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

বাংলা নিউজ •

কক্সবাজার বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) মো. মাহফুজুল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মে প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। গত দুই বছরে ভুয়া বিল-ভাউচারসহ একাধিক খাতে আরডি মাহফুজুল এসব দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ শিল্পী গোষ্ঠীর। এসব কাজে পরিচালককে সহায়তার জন্য অনুষ্ঠান বিভাগের ক্যাজুয়াল স্টাফ নিরুপা পাল এবং নিজস্ব শিল্পী- উপস্থাপক সানুচিং মার্মাকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। 

মাহফুজুলের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে খুব শিগগির আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন শিল্পীরা।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার বেতার শিল্পী সমন্বয় পরিষদের নির্বাহী সভাপতি ও বেতারের নাট্য প্রযোজক জসীম উদ্দিন বকুল বলেন, আরডি মাহফুজুলের আর্থিক অনিয়ম অতীতে বেতারের সব ধরনের অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি যোগদানের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এর সিংহভাগই শিল্পীদের টাকা। এসব অনিয়মের প্রতিকার ও আরডিসহ সংশ্লিষ্টদের শাস্তির দাবিতে খুব শিগগির তথ্যমন্ত্রী, বেতারের মহাপরিচালক, দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে।

আরডির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গেলে একাধিক ঘটনা বেরিয়ে আসে। জানা যায়, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত উন্নয়নের অগ্রযাত্রা শীর্ষক ‘বহিরাঙ্গন’ অনুষ্ঠান ঘিরেও শিল্পী সম্মানীর টাকা নিয়ে অনিয়ম করেন তিনি। বেতার থেকে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো শিল্পী সম্মানীর তালিকায় এক থেকে ছয় নম্বরে দেখা যায় ইস্কান্দার মীর্জা, ফারিহা জাহান টুইংকেল, জিন্নুরাইন মোস্তারী হীরা, দেলোয়ার হোসেন, নাজনীন সুলতানা ও মরিয়ম বেগম মারিয়ার নাম।  সেখানে প্রত্যেক শিল্পীর নামে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী দেখানো হলেও বাস্তবে প্রত্যেকে পেয়েছেন তিন থেকে চার হাজার করে টাকা। সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা বাংলানিউজকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। 

ইস্কান্দার মীর্জা জানান, অতীতেও এ ধরনের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে শিল্পীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনিয়ম আরও বেড়ে গেছে।  

শুধু শিল্পী সম্মানী নয়, বিস্তারিত খোঁজ নিলে জানা যায়, অনুষ্ঠানের সাউন্ড সিস্টেম ও মনিটর কটলেস ভাড়া বাবদও অনিয়ম করা হয়। এসব বাবদ দুইটি পৃথক ভাউচারে ২৫ ও ২৩ হাজার করে মোট ৪৮ হাজার টাকা খরচ দেখানো হলে বাস্তবে বিল দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। সাউন্ড সিস্টেমের মালিক ফরমান রেজা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। 

অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন ঘোষক নীলোৎপল বড়ুয়া ও  শরমিন সিদ্দিকা লিমা। তারা জানান, বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানের খরচের বিল দেখে তারা রীতিমত অবাক হয়েছেন। এতে ৩১টি খাতে সাড়ে তিন লাখ টাকা বিল উত্তোলন করা হলেও বাস্তবে খরচ হয় এক লাখ টাকার মতো। 

নীলোৎপল বড়ুয়া বলেন, উপস্থাপনাবাবদ প্রত্যেকের নামে পাঁচ হাজার টাকা করে বিল ধরা হলেও দুই জনকে মোট পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।  

একইভাবে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো এপ্রিল মাসের আরেকটি অনুষ্ঠান ‘মিউজিক্যাল শো’ ঘিরেও একই রকম অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। দেখা যায়, এ অনুষ্ঠানে ‘এসএমএস যাচাইবাছাই ও লিপিবদ্ধ করণ’ ও মিক্সিংবাবদ বিলের ৫৬ থেকে ৭৪ নম্বরের মধ্যে সাবরিনা সিদ্দিকা ইতি, স্মৃতি মল্লিক, রাবেয়া আক্তার, মোকারমা খানম টুম্পার নামে ৯৬০০ টাকা করে ও মংছেন রাখাইনের নামে ৭২০০ টাকাসহ প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ভুয়া বিল উত্তোলন করা হয়েছে। 

অথচ তালিকায় থাকা মংছেন বলেন, আমি অনেকদিন ধরে বেতারে নেই। এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকরি করছি। এ বিলের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এমনকি আমি কোনোদিন মিউজিক্যাল শোতে মিক্সিংয়ের কাজ করিনি। এ খাতে কোনো দিন একটি টাকাও পাইনি। 

অন্যদিকে শিল্পী সম্মানী রেজিস্টারে দেখা গেছে, বিভিন্ন জনের নামে ভুয়া বিল করা হলেও সবার পক্ষে স্বাক্ষর করে বেতারের নিজস্ব শিল্পী সানুচিং মার্মা সে সব টাকা উত্তোলন করেছেন। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সানুচিং বলেন, আমি স্বাক্ষর করে টাকা তুলেছি ঠিকই, কিন্তু প্রতিবারই এই টাকা তুলে আরডি স্যারকে দিয়ে দেওয়া হয়।  

বিভিন্নভাবে কেবল এ অনুষ্ঠান থেকেই গত দুই বছরে দশ লাখ টাকার মতো আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আরেক অভিযোগে কক্সবাজার বেতারের রেডিও এনাউন্সার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম জানান, গত জুন মাসে প্রতিদিন দু’জন করে এক মাসে ৬০টি উপস্থাপনার বিল হওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় ৯২টি বিলের টাকা। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

কক্সবাজার বেতার শিল্পী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও নাট্য প্রযোজক স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নানা অনিয়মের অভিযোগে শিল্পীদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক মো. হাবিবুর রহমানকে স্ট্যান্ড-রিলিজ করা হয়। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব অবহেলার কারণেই মাহফুজুল হক আরও বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতির সাহস পেয়েছেন। 

হিসাব রক্ষণ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে কক্সবাজার বেতারের অনুষ্ঠানখাতে তিন ধাপে শিল্পী সম্মানীখাতে ৯২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া বাজেট, বিল ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনা থেকে জানা গেছে, কক্সবাজার বেতারে রোহিঙ্গা  ইউনিসেফের সহযোগীতায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সচেতনতামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে চলতি বছর দুই কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়।  

শিল্পীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আরডি মাহফুজ যোগদানের পর থেকে গত দুই বছরে শিল্পী খাত ও  ইউনিসেফের প্রকল্প থেকে কোটি টাকারও বেশি অনিয়ম করেছেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে।  

শুধু বহিরাঙ্গন বা মিউজিক্যাল শো নয়, ‘জীবনের জন্য’, ‘জীবনের জন্য ফোন-ইন’, ‘সোনালী জীবন’, ‘নিসর্গ’, ‘সাগরপাড়ের জীবন’সহ নিয়মিত প্রায় ১৫টি অনুষ্ঠানে আর্থিক অনিয়ম করা হয় বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।  

এসব অভিযোগের ব্যাপারে আরডি মাহফুজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব অনিয়মের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি অফিসের বাইরে আছি, দেখে বলতে হবে।  

আরডির দুর্নীতিতে সহযোগিতার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বেতারের ক্যাজুয়াল স্টাফ নিরুপা পালও অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কোনো ধরনের অনিয়ম করিনি।  একটি মহল আমার নামে এসব মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। 

অন্যদিকে কেবল আর্থিক অনিয়ম নয়, আরডির বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগও রয়েছে শিল্পী মহলের। এ বিষয়ক কিছু তথ্য-উপাত্তও রয়েছে বাংলানিউজের কাছে। 

যদিও এ ধরনের অভিযোগও বাংলানিউজের কাছে অস্বীকার করেন আরডি মাহফুজুল হক।